আয়ের সবচেয়ে বড় খাত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ থাকায় রাষ্ট্রীয় ক্যারিয়ার বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স বিপাকে পড়েছে। চলতি এপ্রিল মাসে উড়োজাহাজের লিজ ভাড়া, মেইনটেনেন্স খরচ এবং ব্যাংক ঋণের কিস্তি হিসেবে ৬২৮ কোটি টাকা দিতে হবে। কর্মীদের বেতন ও বিভিন্ন দেশে অফিস রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মিলে মাসিক মোট খরচ ২০৩ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে শুধু চলতি মাসেই বিমানের খরচ ৮৩১ কোটি টাকা। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ছোবলে গোটা বিশ্বের পাশাপাশি দেশের এভিয়েশন খাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোকাব্বির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, কর্মীদের বেতন নিয়ে আপাতত খুব একটা সমস্যা হবে না। তবে এয়ারক্রাফট মেইনটেনেন্স, উড়োজাহাজ লিজ ও ব্যাংক ঋণের কিস্তি নিয়ে বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় আছি। বর্তমান যে অবস্থা এটা চলতে থাকলে আগামীতে বিমানে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে।
তিনি বলেন, সংকট মেটাতে ইতোমধ্যে পাইলট, কেবিন ক্রুসহ ষষ্ঠ স্তরের উপরের কর্মকর্তাদের বেতনের ১০ শতাংশ কর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া সব ধরনের ওভারটাইম বাতিলসহ খরচের ১০টি খাত কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, তিন মাসে রাজস্ব আয়ে ৪০২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে তিন মাসে বিমান ১২শ’ কোটি টাকার বেশি আর্থিক চাপের মধ্যে আছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ অঙ্ক আরও বাড়বে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, দেশের এয়ারলাইনন্সগুলো মাসে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার বাজার নিয়ে কাজ করে। অর্থাৎ এ বাজার বছরে প্রায় আট হাজার ৪০০ কোটি টাকার। কাজেই সরকারের উচিত দ্রুত এ সেক্টরের জন্য বড় অংকের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা।
শুধু বিমান নয়, একই অবস্থা দেশীয় অপর তিনটি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, নভোএয়ার ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজেরও। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ছোবলে গোটা বিশ্বের পাশাপাশি বিপর্যস্ত দেশের এভিয়েশন খাত। দেশের চারটি বিমান সংস্থার প্রায় ৪৪টি উড়োজাহাজের মধ্যে ৪৩টিই এখন গ্রাউন্ডেড। এর মধ্যে রয়েছে- বিমানের ১৮টি, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ১৩টি, নভোএয়ারের সাতটি এবং রিজেন্ট এয়ারওয়েজের ছয়টি উড়োজাহাজ। এ অবস্থায় সিভিল এভিয়েশন চার্জ, উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মীদের বেতনসহ নানা ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস উঠেছে উদ্যোক্তাদের। রিজেন্ট এয়ারওয়েজ তিন মাসের জন্য কার্যক্রম স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। শুধু ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ গুয়াংজু রুটে চালু আছে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপে ইউএস-বাংলার ২৫০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, গত আট মাসে তারা ছয়টি ব্র্যান্ডনিউ উড়োজাহাজ এনেছেন। ফ্লাইট বন্ধ হলেও ব্যাংকের কিস্তি, উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ, বিভিন্ন কর, সিভিল এভিয়েশনের নানা চার্জ, অফিস খরচ এবং কর্মীদের বেতনভাতা দিতে গিয়ে তারা বড় ধরনের সংকটে পড়েছেন। তিনি বলেন, চীন সরকারের প্রণোদনায় গুয়াংজুতে ল্যান্ডিং-পার্কিং চার্জে ১০ শতাংশ ছাড় দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দেশে এ ছাড় নেই। তার মতে টিকে থাকতে না পারলে অসংখ্য কর্মী চাকরি হারাবে। দেশের এ খাত বিদেশিদের হাতে চলে যাবে। এ অবস্থায় জরুরি প্রণোদনা চেয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের নির্বাহী পরিচালক এয়ার কমোডর (অব.) গোলাম তৌহিদ। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, করোনাভাইরাসের পরিস্থিতিতে এভিয়েশন খাত ভবিষ্যতে কত মারাত্মক ক্ষতিতে পড়বে তা নিরূপণ করা যাচ্ছে না। এ ধরনের দুর্যোগে এয়ারলাইন্স শিল্প দেউলিয়া হয়ে যাবে।
তাই নেভিগেশন, ল্যান্ডিং ও পার্কিং চার্জ পাঁচ বছরের জন্য মওকুফ করা, প্রণোদনাস্বরূপ এভিয়েশন শিল্পকে আগামী ১০ বছরের জন্য বিবিধ আয়কর ও ভ্যাট অব্যাহতি প্রদান, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক হারের জ্বালানি মূল্য ধার্যকরণ, যন্ত্রাংশ আমদানি পর্যায়ে ‘আগাম কর’ অব্যাহতি, বকেয়া পরিশোধের ক্ষেত্রে লেট ফি অন্যসব দেশের মতো বার্ষিক ৬-৮ শতাংশ হারে ধার্য করা, বাংলাদেশি এয়ারলাইন্স আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করলেও তাদের উড়োজাহাজগুলোর ল্যান্ডিং, পার্কিং ও নেভিগেশন চার্জ অভ্যন্তরীণ রুটের হারে ধার্য করার দাবি জানানো চিঠিতে।
এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এওএবির) মহাসচিব ও নভোএয়ারের এমডি মফিজুর রহমান বলেন, আমরা ইতোমধ্যে এভিয়েশন খাতের সব ধরনের কর বাতিলের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে দিয়েছি। একই সঙ্গে সুদছাড়া বড় অংকের টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা এবং অন্তত দুই প্রান্তিকে ব্যাংক সুদবিহীন ডেফার্ড পেমেন্টের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি দাবি জানান।
এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, দেশের বিমান সংস্থাগুলোর প্রতি আমাদের সহানুভূতি আছে। আর্থিক বিষয়গুলোতে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়। বিশ্বের অন্য সব দেশে এভিয়েশন শিল্পকে বাঁচাতে যেভাবে দেখা হচ্ছে, আমরাও সেই পদক্ষেপ নেব।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. মোকাব্বির হোসেন বলেন, ২০১৯ সালে কার্গো পণ্য ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং খাতে ৯০০ কোটি টাকা আয় করেছিল সংস্থাটি। গড়ে প্রতি মাসে ৭৫ কোটি টাকা আয় করত বিমান। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে আমদানি-রফতানি কমে যাওয়া, ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৯০ কোটি টাকা আয় করেছেন তারা। গড়ে আয় হয়েছে মাসে ৩০ কোটি টাকা। এখন আয় নেই বললেই চলে। উল্টো আগাম টিকিট যারা কেটেছিলেন তাদের প্রায় ১৪ কোটি টাকা ফেরত দিতে হয়েছে।